ব্যবস্থাপনা নীতি

ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা - ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা ২য় পত্র - ব্যবস্থাপনা নীতি

“নীতি-নৈতিকতা মেনে চলা উচিত'- এ আপ্তবাক্য সকল সমাজেই প্রচলিত । তাই নিঃসন্দেহে নীতি এমন ইতিবাচক বিষয় যা মেনে চললে এর দ্বারা সংশ্লিষ্ট সবাই উপকৃত হতে পারে । নীতি হলো কাজের সাধারণ নির্দেশিকা । প্রতিটা ক্ষেত্রে কিভাবে করলে কাজটা সুন্দরভাবে সম্পাদন করা যাবে দীর্ঘদিনে এ ধরনের প্রতিষ্ঠিত সত্য হিসেবে কিছু উপায়-পদ্ধতি বেরিয়ে এসেছে যাকে নীতি হিসেবে দেখা হয়ে থাকে । ব্যবস্থাপনার নীতিগুলো কী হতে পারে অনেকেই এ নিয়ে দীর্ঘদিনে প্রতিষ্ঠিত সত্যগুলো তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন । হেনরি ফেওল প্রদত্ত ১৪টি মূলনীতি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ । একজন আদর্শ ব্যবস্থাপকের কী কী গুণ থাকা উচিত তাও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। আগামী দিনে যারা যোগ্য ব্যবস্থাপক হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে চায় নিঃসন্দেহে এ সকল জ্ঞান তাদের যোগ্য ব্যবস্থাপক হতে সহায়তা করবে ।

চিত্র : ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের দু'জন প্রধান দিকপাল হেনরি ফেয়ল (বামে) ও এফ.ডব্লিউ. টেলর (ডানে)

এ অধ্যায় পাঠ শেষে শিক্ষার্থীরা (শিখন ফল)

১. ব্যবস্থাপনা নীতির ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারবে ।

২. ব্যবস্থাপনার নীতি বা আদর্শসমূহ বর্ণনা করতে পারবে ।

৩. এফ. ডব্লিউ, টেলর ও হেনরি ফেয়লের অবদান ব্যাখ্যা করতে পারবে।

৪. আদর্শ ব্যবস্থাপকের দক্ষতা ও গুণাবলি বর্ণনা করতে পারবে ।

৫. আদর্শ ব্যবস্থাপকের ভূমিকা বিশ্লেষণ করতে পারবে।

৬. ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারবে ।

৭. সংগঠন, ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনের মধ্যে সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে পারবে।

৮. বাংলাদেশে ব্যবস্থাপনা ক্ষেত্রে বিরাজমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পারবে ।

Content added By

ব্যবস্থাপনা নীতির ধারণা

আমরা কোঁনো কাজ নানানভাবেই করতে পারি । বসে, শুয়ে, দাঁড়িয়ে নানানভাবেই খাওয়া যায় । কিন্তু মানুষ শুরু থেকেই বুঝেছে শুয়ে খাওয়ার চেয়ে বসে খাওয়া সহজ ও উত্তম । সুষম খাদ্য খাওয়া ভালো, অতিভক্ষণ স্বাস্থ্য ও কাজের জন্য ক্ষতিকর- এ বিষয়গুলো মানুষ আপনা-আপনি বুঝেছে, শিখেছে ও তা রপ্ত করেছে। এভাবেই চিন্তা ও কাজ করতে করতে মানুষ ঐ চিন্তা ও কাজ করার সাধারণ নির্দেশিকা বা করণীয় কর্তব্য নির্দিষ্ট করে তা পালন করে এগিয়ে গেছে । এই সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত ও সকলের নিকট গ্রহণীয় নিয়ম-পদ্ধতিকেই নীতি বলে । যখনই মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে চলা শুরু করেছে তখন থেকেই তারা তাদের মধ্য থেকে কাউকে নেতা বা প্রধান হিসেবে মেনেছে ও তার আনুগত্য করেছে । অন্যদিকে নেতা বা প্রধান তাদেরকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার মাধ্যমে দলীয় উদ্দেশ্য অর্জন বা স্বার্থরক্ষার চেষ্টা চালিয়েছেন। এভাবে সমাজ বড় হয়েছে, নানান সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা জোরদার হয়েছে ও সেই সাথে ব্যবস্থাপনা কার্যও ততই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নেতা, প্রধান বা ব্যবস্থাপকগণ কিভাবে তাদের কাজগুলোকে সুন্দরভাবে সম্পাদন করবেন সে বিষয়ে নানান নিয়ম-পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন । সকলের নিকট গ্রহণীয় ও উত্তম বলে প্রতিষ্ঠিত এরূপ নিয়ম-পদ্ধতিই পরবর্তীতে ব্যবস্থাপনার নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।

ব্যবস্থাপনা নীতি হলো ব্যবস্থাপনা কার্য সম্পাদনের সাধারণ পথ নির্দেশনা (Guidance for action)। দীর্ঘদিনে ব্যবস্থাপনা কার্য পরিচালনা করতে যেয়ে ব্যবস্থাপকগণ যে সকল নিয়ম-নীতি পালন করে এসেছেন তার মধ্য হতে সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য বা সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত নিয়ম-নির্দেশিকাই ব্যবস্থাপনার নীতি হিসেবে গণ্য । একজন ব্যবস্থাপক যখন কিছু লোক নিয়ে প্রতিষ্ঠান চালায় তখন অধস্তনদের মাঝে কাজকে ভাগ করে দিতে হয় । তাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব ও ক্ষমতা নির্দিষ্ট করে দেয়ার প্রয়োজন পড়ে । এতে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে এবং জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকে । এভাবে কে কাকে নির্দেশ দেবে, কে কার নির্দেশ পালন করবে তা যদি ঠিক করে দেয়া না হয়, একজন কর্মীর একাধিক আদেশদাতা যাতে না থাকে এটা যদি নিশ্চিত করা না হয় তবে কাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়াই স্বাভাবিক । এভাবে অনেক নিয়ম-পদ্ধতির কথা বলা যাবে যেগুলো মেনে চললে পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত সকল ব্যবস্থাপক বা পরিচালকগণই ভালো ফল পেতে পারেন । তাই এ সংক্রান্ত নিয়ম-পদ্ধতি বা নির্দেশনাকেই ব্যবস্থাপনার নীতি হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় ।

ব্যবস্থাপনার কাজ বলতে পরিকল্পনা, সংগঠন, কর্মীসংস্থান, নির্দেশনা, প্রেষণা, সমন্বয়, নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি কাজকে বুঝায় । এর প্রতিটা কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে পূর্ব নির্ধারিত কিছু সাধারণ নির্দেশিকা রয়েছে। যা পালন করা হলে প্রতিটা কাজে উত্তম ফললাভ সম্ভব । একইভাবে সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা কার্যের ক্ষেত্রেও এরূপ পালনীয় নির্দেশিকা বা নীতিমালা থাকে। এরূপ নীতিমালা এমন নিয়ম-নীতিসমূহের নির্দেশ করে যা ব্যবস্থাপনার কার্যাবলি সহজে ও সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য পথনির্দেশক ও নিয়ন্ত্রক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এরূপ নীতিসমূহ দীর্ঘ অনুশীলনের মধ্য দিয়ে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত থাকে যা সর্বজনীনভাবে প্রয়োগযোগ্য ।

Content added || updated By

ব্যবস্থাপনার নীতি বা আদর্শসমূহ

ব্যবস্থাপনা নীতি হলো ব্যবস্থাপনা কার্য সম্পাদনে দীর্ঘ অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা কতিপয় সাধারণ নির্দেশিকা বা নিয়ম-পদ্ধতি । এরূপ নির্দেশিকা মেনে চললে ব্যবস্থাপনা কাজ সুন্দর ও সুচারুরূপে সম্পাদন করা সম্ভব হয়। তাই এরূপ নির্দেশিকা কী হতে পারে তা নির্ধারণের জন্য ব্যবস্থাপনা বিশারদগণ চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন জন বিভিন্ন বিষয়কে নীতি হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। এফ. ডব্লিউ. টেলর, এল. উরউইক, হেনরি ফেয়ল ইত্যাদি মনীষীবর্গের নাম এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য । আধুনিক ব্যবস্থাপনা তত্ত্বের জনক হেনরি ফেয়ল ফরাসী ভাষায় তাঁর লেখা Administration Industrielle et General গ্রন্থে ব্যবস্থাপনার ১৪টি মূলনীতির নির্দেশ করেছেন যা অদ্যাবধি বিশ্বের সকল মহলে স্বীকৃত হয়ে আসছে। নিম্নে তার প্রদত্ত মূলনীতিসমূহ আলোচনা করা হলো:

১. কর্ম বিভাজন বা কার্য বিভাগের নীতি (Principle of division of work) : প্রতিষ্ঠানের কাজকে প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে প্রত্যেকের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট করার নীতিকেই ব্যবস্থাপনায় কার্য বিভাজনের নীতি বলে । যে কোনো ব্যবস্থাপনা কার্যে কর্ম বিভাজন বা কার্য বিভাগ এর প্রথম ও প্রধান পালনীয় নীতি । একজন ব্যবস্থাপক অধস্তন জনশক্তি নিয়ে কাজ করেন। এদের কাজ যদি ভাগ করে সেভাবে নির্দিষ্ট করে দেয়া না হয় তবে কার্যক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেবে। প্রত্যেকেই সহজ বা মর্যাদাসম্পন্ন কাজটি করতে চাইবে। অন্যদিকে প্রত্যেকের কাজ নির্দিষ্ট না থাকায় কাউকে জবাবদিহি করাও যাবে না। তাই একজন ব্যবস্থাপককে সবসময়ই সতর্কতার সাথে কাজকে ভাগ করে প্রত্যেক কাজের দায়িত্ব ও ক্ষমতা ব্যক্তিবর্গের মধ্যে নির্দিষ্ট করে দিতে হয়। যাতে কর্মী তার কাজ, কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা বুঝে নিয়ে সেভাবে কাজ করতে পারে। এতে একই ধরনের কাজ করতে যেয়ে কর্মীর কার্যদক্ষতা যেমনি বাড়ে তেমনি ব্যবস্থাপকের পক্ষে অধস্তনদের কাজ তত্ত্বাবধান ও জবাবদিহিতা করা সহজ হয়।

২. কর্তৃত্ব ও দায়িত্বে সমতা রক্ষণের নীতি (Principle of balancing authority and responsibility): কর্তৃত্ব হলো আদেশ দানের অধিকার। অন্যদিকে দায়িত্ব হলো জবাবদিহি করার বাধ্য-বাধকতা । এই অধিকার ও বাধ্য-বাধকতায় সমতা রক্ষার নীতিকেই কর্তৃত্ব ও দায়িত্বে সমতা রক্ষণ বলে। কোনো ব্যক্তির নিকট থেকে সঠিকভাবে কাজ পেতে চাইলে তাকে যেমনি কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে হয় তেমনি উভয়ের মধ্যে যাতে সমতা বজায় থাকে সেটিও নিশ্চিত করা আবশ্যক। একজনকে হিসাব নিরীক্ষার দায়িত্ব দিলে তাকে প্রয়োজনীয় খাতা-পত্র ও হিসাব তলব করার কর্তৃত্বও প্রদান করা উচিত । অন্যথায় তার পক্ষে হিসাব নিরীক্ষার কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা সম্ভব হবে না। একইভাবে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা যদি অনেক বেশি থাকে কিন্তু সেই পরিমাণে কারও নিকট তাকে জবাবদিহি করতে না হয় তবে ব্যক্তি স্বেচ্ছাচারী হতে বাধ্য । অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বৈরাচারী নেতৃত্ব সৃষ্টি হওয়ার মূল কারণ এখানেই ।

৩. কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণের নীতি (Principle of centralization and decentralization): প্রতিষ্ঠানে কোন ধরনের সিদ্ধান্ত ব্যবস্থাপনার কোন পর্যায়ে গ্রহণ করা হবে এ বিষয়ক নীতিকেই কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণের নীতি বলে । যদি এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সকল ক্ষমতা ব্যবস্থাপনার উপরিপর্যায়ে সংরক্ষণ করা হয় তাকে কেন্দ্রীকরণ বলে। অন্যদিকে এরূপ ক্ষমতা নিচের পর্যায়ের ব্যবস্থাপকদের হাতে ছেড়ে দেয়া হলে তাকে বিকেন্দ্রীকরণ বলে । একটা প্রতিষ্ঠানের জন্য সম্পূর্ণ কেন্দ্রীকরণ ও সম্পূর্ণ বিকেন্দ্রীকরণ কোনোটিই লাভজনক নয়। সম্পূর্ণ কেন্দ্রীকরণ অধস্তনদের গুরুত্ব হ্রাস করে। ফলে তাদের দক্ষতা ও আগ্রহ হ্রাস পায়। অন্যদিকে সম্পূর্ণ বিকেন্দ্রীকরণ করা হলে ঊর্ধ্বতন অধস্তনদের ওপর কর্তৃত্ব হারায় । তাই প্রতিষ্ঠানে উভয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠানের উপরিস্তরে এবং কম গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থাপনার নিচের স্তরে প্রদান আবশ্যক ।

৪. আদেশের ঐক্য নীত (Principle of unity of command): একজন কর্মীর আদেশকর্তা হবেন একজন মাত্র ব্যক্তি-এরূপ হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিতকরণের নীতিকেই ব্যবস্থাপনায় আদেশের ঐক্য নীতি বলে। অর্থাৎ কোনো অধস্তন (Subordinate) একজন ঊর্ধ্বতন (Boss) এর নিকট থেকেই সরাসরি আদেশ লাভ করবে এবং তার কাজের জন্য ঐ ঊর্ধ্বতনের নিকট জবাবদিহি করবে। কখনই একাধিক ব্যক্তির নিকট থেকে আদেশ লাভ বা এভাবে জবাবদিহি করবে না । ধরা যাক, প্রতিষ্ঠানে ৫ জন ফোরম্যান ক নামক একজন সুপারভাইজারের অধীন। এক্ষেত্রে উক্ত ৫ জন ফোরম্যানের প্রত্যেকের একক আদেশদাতা হলেন ক। এক্ষেত্রে উক্ত প্রত্যেক ফোরম্যান তাদের অধস্তন শ্রমিকদের কাজের জন্য ক এর নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে। যদি উক্ত ফোরম্যানদের দু'জন আদেশকর্তা থাকে এবং দু'জন দু'ধরনের আদেশ দেন তবে অধস্তনদের পক্ষে সুষ্ঠুভাবে কাজ করা কোনোক্রমেই সম্ভব হবে না। একজন অফিস পিয়ন যদি একাধিক বিভাগীয় প্রধানের অধীনে কাজ করে তবে সেক্ষেত্রেও দ্বৈত অধীনতার কারণে তার কাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়াই স্বাভাবিক ।

৫. নির্দেশনার ঐক্য নীতি (Principle of unity of direction): উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য পূর্ব নির্দেশনার সাথে মিল রেখে পরবর্তী নির্দেশনা প্রদানের কাজকেই ব্যবস্থাপনায় নির্দেশনার ঐক্য নীতি বলে । একটা সামগ্রিক উদ্দেশ্য বা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিষয়টি মাথায় রেখে তার আলোকে প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়ে থাকে । ধরা যাক, প্রতিষ্ঠানে কিছু যোগ্য বিক্রয় কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হবে। এ জন্য বিজ্ঞপ্তি তৈরি, পত্রিকায় প্রেরণ, আবেদনপত্র জমা গ্রহণ, আবেদন পত্র বাছাই, নিয়োগ পরীক্ষার কার্ড ইস্যু, পরীক্ষা অনুষ্ঠান ইত্যাদি বিষয়ে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপককে সংশ্লিষ্ট অধস্তনদের ধারাবাহিক নির্দেশনা দিতে হবে। এক্ষেত্রে যদি তিনি একবার পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়ার নির্দেশ দিয়ে পরে আবার সেখান থেকে সরে এসে বিজ্ঞপ্তি লিখে দেয়ালে দেয়ালে টাঙানোর নির্দেশ দেন, পরীক্ষা কিভাবে নেয়া হবে এ বিষয়ে পূর্ববর্তী নির্দেশনার সাথে মিল না রেখেই পরবর্তী নির্দেশ প্রদান করেন তবে স্বভাবতই উদ্দেশ্য অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে এবং এতে ঊর্ধ্বতন সম্পর্কে অধস্তনদের মনে খারাপ ধারণা জন্মাবে।

৬. সাধারণ স্বার্থে নিজস্ব স্বার্থ ত্যাগের নীতি (Principle of subordination of individual interest to general interest): ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে প্রাতিষ্ঠানিক বা সাধারণ স্বার্থকে অগ্রাধিকার প্রদানের নীতিকেই ব্যবস্থাপনায় সাধারণ স্বার্থে নিজস্ব স্বার্থ ত্যাগ এর নীতি বলে। একটা ব্যবসায়ে কর্মরত প্রতিটা ব্যক্তি, বিভাগ ও উপবিভাগ যদি প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থকে বড় করে দেখে তবে সেক্ষেত্রে দলীয় চেতনা (Team spirit) বৃদ্ধি পায় ও প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে তারা ছোটখাটো বিভেদ এড়িয়ে চলে। এতে প্রতিষ্ঠান অধিক মুনাফা অর্জন করতে পারে । এতে জনশক্তির বেতন ও সুযোগ-সুবিধাও বাড়ে। অন্যদিকে যদি কর্মরত প্রত্যেকেই নিজের স্বার্থকে বড় করে দেখে তবে প্রাতিষ্ঠানিক বা সাধারণ স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় । একটা দেশের ক্ষেত্রেও এ নীতি প্রযোজ্য । সরকার, সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সবাই যদি দেশপ্রেম নিয়ে দেশের স্বার্থকে বড় মনে করে কাজ করে তবে দেশ ও দেশের মানুষ সবাই উপকৃত হয় । কিন্তু যখন প্রত্যেকেই যার যার জায়গায় ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করাকে অগ্রাধিকার দেয় তখন এক পর্যায়ে দেশ ও জনগণ সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে।
৭. জোড়া-মই-শিকলের নীতি (Principle of scalar chain) : প্রতিষ্ঠানের ওপর থেকে শুরু করে একেবারে নিচের স্তর পর্যন্ত সাংগঠনিক নিয়মে প্রতিটা ব্যক্তি, বিভাগ ও উপবিভাগকে একে অন্যের সাথে যুক্ত করে দেয়ার বা একই শিকলের অধীনে সবাইকে আবদ্ধ করার নীতিকেই ব্যবস্থাপনায় জোড়া মই-শিকল নীতি বলে । এতে শিকলের ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত পারস্পরিক আবদ্ধতা কর্তৃত্ত্বের প্রবাহ ও যোগাযোগের পথ নির্দেশ করে। কে কার অধীন, কে কার অধস্তন সহজে বোঝা যায়। ফলে সংঘবদ্ধতা জোরদার হয় । প্রতিষ্ঠানের যে কোনো পর্যায়ে সমস্যা দেখা দিলে তা উর্ধ্বতন সহজে জানতে পারে ও দ্রুত তার সমাধা সম্ভব হয়ে থাকে। উল্লেখ্য কোনো ব্যক্তি দলছাড়া হয়ে গেলে বা দলের বাইরে থাকলে তা তার জন্য যেমনি সমূহ ক্ষতি বয়ে আনতে পারে তেমনি দলের জন্যও তা ক্ষতির কারণ হয়। একটা প্রতিষ্ঠানে কোনো ব্যক্তি, বিভাগ বা উপবিভাগ যদি এই শিকলের বাইরে থাকে তবে তাকে বা তাদের কাজে লাগানো বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। ফলে ঐ ব্যক্তি বা বিভাগ স্বেচ্ছাচারী হয় এবং প্রতিষ্ঠানের জন্য তা মন্দ উদাহরণ সৃষ্টি করে ।

৮. নিয়মানুবর্তিতার নীতি (Principle of discipline): প্রতিষ্ঠানের জন্য উত্তম নিয়ম-নীতি নির্ধারণ এবং তা মেনে চলার নীতিকেই ব্যবস্থাপনায় নিয়মানুবর্তিতার নীতি বলে । প্রতিষ্ঠানে যথোপযুক্ত নিয়ম-নীতি না থাকলে এবং তা সংশ্লিষ্ট সবাই মান্য না করলে প্রতিষ্ঠান কখনই ভালো চলতে পারে না । এই নীতি অনুযায়ী মনে করা হয়। যে, প্রাতিষ্ঠানিক নীতি ও নিয়মের প্রতি সকলের শ্রদ্ধাবোধ ও তা মান্য করার ঐকান্তিক আগ্রহ সফলতা অর্জনের জন্য অপরিহার্য। আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহে লক্ষণীয় যে, সেখানে নিয়ম-নীতি থাকলেও অনেকেই তা পরোয়া করে না । ফলে সেখানকার কার্যপরিবেশ ও সংশ্লিষ্টদের কার্যদক্ষতার মান খুবই হতাশাব্যঞ্জক । অন্যদিকে বেসরকারি বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানসমূহে সুষ্ঠু নিয়ম-নীতি প্রণয়ন ও তা মান্য করার বিষয়ে খুবই জোর দেয়া হয়। ফলে সেখানে কার্য পরিবেশ ও কার্যমান উন্নত হয়ে থাকে । হেনরি ফেওল এক্ষেত্রে মনে করেছেন যে, ঊর্ধ্বতনগণ যদি নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকেন তবে প্রতিষ্ঠানে নিয়মানুবর্তিতার নীতি অনুসরণ সহজ হয়।

৯. শৃঙ্খলার নীতি (Principle of order): যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য স্থানে এবং সঠিক বস্তুকে সঠিক স্থানে স্থাপনের নীতিকেই ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলার নীতি বলে। এক্ষেত্রে শৃঙ্খলা বলতে উপায়-উপকরণাদির শৃঙ্খলাকে বুঝানো হয় । যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য স্থানে বসানো না গেলে কখনই তার নিকট থেকে কাঙ্ক্ষিত ফললাভ সম্ভব হয় না । আমাদের অনেক প্রতিষ্ঠানে প্রায়শই লক্ষণীয় যে, ব্যক্তির যোগ্যতা বা মেধার চাইতেও ব্যক্তিগত সম্পর্ক, রেফারেন্স, ব্যক্তিগত লাভালাভ ইত্যাদিকে গুরুত্ব দেয়া হয়। ফলে মানবীয় শৃঙ্খলা বলতে সেখানে কিছুই থাকে না । কার্যত অদক্ষতা-অযোগ্যতাকেই সেখানে লালন করা হয়। যা কখনই প্রতিষ্ঠানের জন্য ভালো ফল দেয় না। অন্যদিকে যেই প্রতিষ্ঠান যোগ্য লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে আন্তরিক থাকে সেখানে কখনই অদক্ষতা, অনিয়ম ইত্যাদি ভর করতে পারে না । বস্তুগত শৃঙ্খলার বিষয়টাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ । যে যন্ত্রটি যেখানে থাকা দরকার, যাকে যে ধরনের টেবিল-চেয়ার দেয়া দরকার, কারখানা বিন্যাস, অফিস বিন্যাস ইত্যাদি যেভাবে হওয়া প্রয়োজন তা সেভাবে করলেই তদ্বারা উপযুক্ত ফললাভ সম্ভব।

১০. পারিশ্রমিকের নীতি (Principle of remuneration): প্রতিষ্ঠানের প্রতিটা কর্মীর কাজের প্রকৃতি, মেধা, যোগ্যতা ইত্যাদি বিবেচনায় উপযুক্ত বেতন ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানের নীতিকেই ব্যবস্থাপনায় পারিশ্রমিকের নীতি বলে । যে কোনো প্রতিষ্ঠানেই কর্মরত জনশক্তি তার মেধা, যোগ্যতা ও কাজ অনুযায়ী উপযুক্ত পারিশ্রমিক প্রত্যাশা করে । মালিক পক্ষও তাদের বিনিয়োগকৃত মূলধনের বিপক্ষে উপযুক্ত মুনাফা পেতে চায়। তাই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপকদেরকে উভয় পক্ষের প্রত্যাশা পূরণে যত্নশীল হওয়ার প্রয়োজন পড়ে। বর্তমান প্রতিযোগিতাপূর্ণ ব্যবসায় জগতে প্রতিষ্ঠানের জন্য যোগ্য ও দক্ষ জনবল ধরে রেখে দক্ষতার সাথে কার্যক্রম পরিচালনায় এ নীতির যথাযথ অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই ।

১১. সাম্যের নীতি (Principle of equity): অধস্তনদের সবার প্রতি সমান আচরণ বা স্নেহ প্রদর্শনের নীতিকেই ব্যবস্থাপনায় সাম্যের নীতি বলে । এটি ন্যায়পরায়ণতার সাথেও সম্পর্কযুক্ত। একজন ঊর্ধ্বতন যদি তার সকল অধস্তনকে সমান চোখে দেখেন, সমান আচরণ ও স্নেহ প্রদর্শন করেন তবে অধস্তনদের মাঝে ঊর্ধ্বতন সম্পর্কে সুধারণা গড়ে ওঠে। এতে পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হয় । প্রতিষ্ঠানে আনুগত্য, মান্যতা ও কার্যদক্ষতা বৃদ্ধি পায় । অন্যদিকে ঊর্ধ্বতন যদি তার অধস্তনদের সমান চোখে না দেখেন, বেতন, পদোন্নতি, সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি প্রদানে বৈষম্য করেন তবে সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র ঊর্ধ্বতনের প্রতিই খারাপ ধারণার সৃষ্টি হয় না কর্মীদের নিজেদের মধ্যেও বিবাদ-বিসম্বাদ দেখা দেয়। একজন কর্মী অন্যায় করলেও ঊর্ধ্বতন যদি তার অন্যায় বিবেচনায় শাস্তি প্রদানে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করেন এবং অধস্তন হিসেবে তার সাথে আর পাঁচজনের মতই ব্যবহার করেন তবে উক্ত অধস্তনের মনে ঊর্ধ্বতনের প্রতি শ্রদ্ধা কমে না বরং বৃদ্ধি পায়।

১২. চাকরির স্থায়িত্বের নীতি (Principle of stabilization of service) : এই নীতি অনুযায়ী মনে করা হয়। যে, কর্মীদের চাকরির নিশ্চয়তা বিধান করা হলে তা কর্মীদের মধ্যে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আগ্রহ ও উদ্দীপনা বৃদ্ধি করে । সাধারণভাবে একজন যুবক লেখাপড়া শেষে ভালো চাকরি পাওয়াটাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। যখন সে চাকরি পায় তখন চাকরিটা স্থায়ী হোক এটাই তার প্রত্যাশার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এ পর্যায়ে চাকরি স্থায়ী করা হলে সে তা নিজের জন্য গৌরবের বিষয় মনে করে। এ সময় থেকেই সে নিজেকে প্রতিষ্ঠানের একজন প্রকৃত সদস্য গণ্য করে যা তার কাজের গতি বাড়িয়ে দেয় । কিন্তু প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের চাকরি যদি স্থায়ী করা না হয় তবে ঐ প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মনে যে কোনো সময় চাকরি চলে যাওয়ার ভয়, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বাসা বাঁধে। সে অন্যত্র চাকরি খুঁজতে বাধ্য হয় । একসময় সে কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে । তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যোগ্য কর্মীদের চাকরি স্থায়ীকরণের ব্যবস্থা নেয়া উচিত ।

১৩. উদ্যোগের নীতি (Principle of initiative) : প্রতিষ্ঠানের সকল পর্যায়ের ব্যবস্থাপকগণ স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে যাতে উদ্যোগী হতে পারে বা নিজের কাজের উন্নয়ন বিষয়ে ভাবতে পারে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তার সুযোগ, সৃষ্টিকেই ব্যবস্থাপনায় উদ্যোগের নীতি বলে। ঊর্ধ্বতনদের পক্ষে প্রতিষ্ঠানের সর্বস্তরের কাজের মান উন্নয়ন বা বিদ্যমান সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠার বিষয়ে কার্যকর চিন্তা করা সম্ভব হয় না । তাই প্রতিষ্ঠানে যদি এমন পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব হয় যাতে প্রত্যেক অধস্তন স্ব স্ব স্থানে তাদের কাজের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে ভাবতে ও ঊর্ধ্বতনদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে পারে তবে স্বভাবতই অধস্তনরা উদ্যোমী ও উদ্যোগী হয়ে ওঠে । যা অধস্তনদের প্রতিষ্ঠানের সাথে নিজকে সম্পৃক্ত করতে উৎসাহ যোগায়। অন্যদিকে যদি এ ধরনের পরিবেশকে নিরুৎসাহিত করা হয় এবং এ ধরনের চিন্তাকে অধস্তনদের বাড়াবাড়ি বলে গণ্য করা হয় তবে নিঃসন্দেহে তা স্বচ্ছন্দ ও স্বতঃস্ফূর্ত কর্ম পরিবেশকে বাধাগ্রস্ত করে।

১৪. একতাই বল নীতি (Principle of unity is strength) : প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সকল ব্যক্তি, বিভাগ ও উপবিভাগকে সর্বাবস্থায় ঐক্যবদ্ধ থেকে পারস্পরিক সহযোগিতায় কর্মকাণ্ড পরিচালনার নীতিকেই ব্যবস্থাপনায় একতাই বল নীতি বলে । প্রতিটা বিভাগ ও উপবিভাগের অধীন ব্যক্তিবর্গ যদি বিভাগীয় লক্ষ্য অর্জনের জন্য স্ব স্ব ক্ষেত্রে পরস্পর ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং প্রতিটা বিভাগ ও উপবিভাগ প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রত্যেকের কাজকে অন্যের সাথে সমন্বিত করে একতালে ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে তবে প্রতিষ্ঠান সহজেই তার মূল লক্ষ্য অর্জন করতে পারে । কিন্তু সর্বত্র ঐক্য, সমঝোতা ও সহযোগিতা যদি না থাকে তবে পারস্পরিক বিরোধ, অনৈক্য ও অসহযোগিতা সেখানে প্রকট হয়ে দেখা দেয়। যেখানে প্রতিষ্ঠান কখনই সাফল্য লাভ করতে পারে না। তাই ঊর্ধ্বতনদেরকে এরূপ নীতি বাস্তবায়নে সদা তৎপর থাকতে হয় ।

H. Fayol বর্ণিত উপরোক্ত মূলনীতিসমূহ ছাড়াও বর্তমানে আরও কিছু নীতি ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম পরিচালনায় সাধারণ দিক-নির্দেশনা প্রদান করতে পারে বলে মনে করা হয় :

১. নমনীয়তার নীতি (Principle of flexibility) : চিন্তা, কাজ ও পদ্ধতিতে প্রয়োজনে পরিবর্তন এনে প্রচেষ্টাকে লক্ষ্যাভিমুখী করার নীতিকেই নমনীয়তার নীতি বলে। ব্যবস্থাপনা সমাজ বিজ্ঞানের একটি শাখা। তাই সামাজিক বিভিন্ন পরিবর্তিত পরিবেশের মধ্য দিয়ে ব্যবস্থাপনাকে তার উদ্দেশ্য অর্জন করতে হয়। তাই এরূপ নীতির মূল বক্তব্য হলো পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে সঙ্গতি বিধানে ব্যবস্থাপনার সমর্থ থাকা উচিত । এজন্য ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত যে পরিবর্তন ঘটে তার সঙ্গে ব্যবস্থাপনাকে সঙ্গতি বিধান করে এগিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে ।

২. ভারসাম্যের নীতি (Principle of balancing) : ভারসাম্যের নীতি বলতে প্রতিটা ব্যক্তি, বিভাগ ও উপবিভাগীয় কাজের মধ্যে সমন্বয় বিধান এবং সমতালে এগিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য সৃষ্টিকে বুঝায়। কোনো বিভাগের কাজের দায়িত্ব এবং গুরুত্ব বুঝে লোকবল ও সামর্থ্য নিয়োজিত করা উচিত; যাতে কোন বিভাগ অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে না পড়ে । সকল বিভাগ, উপবিভাগ ও ব্যক্তির কাজ ভারসাম্যপূর্ণ হলে তা প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক কাজে ভারসাম্যাবস্থার সৃষ্টি করে ।

৩. ব্যতিক্রমের নীতি (Principle of exceptions) : ব্যবস্থাপক কোন ক্ষেত্রে তার দৃষ্টি অধিক নিবদ্ধ করবে এরূপ নীতিতে তার প্রতি আলোকপাত করা হয়ে থাকে। একজন ব্যবস্থাপকের পক্ষে তার সবগুলো কাজ সমান গুরুত্ব দিয়ে করা সম্ভব হয় না। এজন্য কোন্ কাজটি উদ্দেশ্য অর্জনে অধিক গুরুত্বপূর্ণ, কোন্ ক্ষেত্রে অধিক বিচ্যুতি ঘটার সম্ভাবনা বিদ্যমান ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে সেভাবে দৃষ্টি প্রদান এবং ব্যবস্থাপনা কার্য পরিচালনা করা আবশ্যক।

Content added By

ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে মনীষীদের অবদান

সমাজ ও সভ্যতার উন্নয়নের সাথে সঙ্গতি রেখে ব্যবস্থাপনার যে উন্নয়ন ঘটেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এক সময় রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল খুবই সাদামাটা ধরনের। তাই তার ব্যবস্থাপনা ছিল সহজ। ব্যবস্থাপনা একটা বিষয়-এটাই ভাবনাতে আসেনি। ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে মনীষীবৃন্দের উন্নয়নচিন্তা প্রাচীনকালে মূলত বিভিন্ন সভ্যতাকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। ব্যবিলনীয় সভ্যতাকালে রাজা হাম্মুরাবি, চৈনিক সভ্যতাকালে সানজু, ভারতীয় সভ্যতাকালে কৌটিল্য, গ্রীক সভ্যতাকালে সক্রেটিস, এরিস্টটল ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গ ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে যে ভূমিকা রেখেছেন তা ইতিহাস থেকে জানা যায়। মধ্যযুগে মুসলিম শাসনকালে আলফারাবি, ইমাম গাজ্জালী প্রমুখ লেখক রাষ্ট্রীয় প্রশাসন কিভাবে দক্ষতার সাথে পরিচালনা করা যায় ও এর সাথে সংশ্লিষ্টদের গুণাবলি কী থাকা উচিত-এ নিয়ে লেখালেখি করেছেন। মধ্যযুগের শেষ দিকে এসে লুকা প্যাসিওলী, স্যার থমাস মুর, নিকোলো ম্যাকিয়াভেলী, স্যার জেমস স্টিউয়ার্ট, এ্যাডাম স্মীথ এবং আরও পরে রবার্ট ওয়েন, চার্লস ব্যাবেজ ইত্যাদি মনীষীবর্গ ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন। তবে অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে শিল্প বিপ্লবের ফলে বৃহদায়তন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠায় এবং একত্রে হাজার হাজার শ্রমিক পরিচালনা ও কাজ আদায় করতে যেয়ে দক্ষ ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন বিশেষভাবে অনুভূত হয়। যে কারণে বেশ কিছু ব্যবস্থাপনা বিশারদ তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে ব্যবস্থাপনা শাস্ত্রের উন্নয়নে অবদান রাখেন। এর মধ্যে হেনরি ফেয়ল, এফ ডব্লিউ, টেলর, এইচ. এল. প্যান্ট, ফ্রাঙ্ক বি. গিলব্রেথ, লিলিয়ান এম. গিলব্রেথ, হুগো মুনস্টারবার্গ, অলিভার শেলডন, এলটন মেয়ো, চেস্টার আই. বার্নার্ড প্রমুখ মনীষীর নাম উল্লেখযোগ্য । তাঁদের পবেষণা, চিন্তা ও কর্ম ব্যবস্থাপনাকে একটা সমৃদ্ধ ও গৌরবময় শাস্ত্রের পর্যায়ে উন্নীত করে। বর্তমানকালে এটি এতটাই সমৃদ্ধ শাস্ত্র যে, এর বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা নিয়ে লেখা-লেখি ও গবেষণার অন্ত নেই । আর্থিক ব্যবস্থাপনা, বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাপনা, উৎপাদন ব্যবস্থাপনা, প্রজেক্ট ব্যবস্থাপনা, হিসাব ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয় এখন আলাদা শাস্ত্রের রূপ পরিগ্রহ করে সামগ্রিক ব্যবস্থাপনাকে আরও বিকশিত ও সুষমামণ্ডিত করেছে।

Content added By

ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে এফ.ডব্লিউ. টেলরের অবদান

এফ.ডব্লিউ, টেলর (১৮৫৬-১৯১৫)

জীবন বৃত্তান্ত (Bio-data) : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার একটা মধ্যবিত্ত পরিবারে ফ্রেডারিক উইন্সলো টেলর ১৮৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষাজীবনে আইনজীবী হওয়ার ইচ্ছায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও খারাপ দৃষ্টিশক্তির কারণে। তার পক্ষে লেখাপড়া চালানো সম্ভব হয়নি। ১৮৭৫ সালে তিনি একটি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে প্যাটার্ন প্রস্তুতকারী মেকানিকের কাজ শেখার জন্য শিক্ষানবীস হিসেবে যোগ দেন। ১৮৭৮ সালে টেলর মিডডেল স্টীল কোম্পানিতে মেকানিক হিসেবে কাজে যোগদান করেন। কার্যক্ষেত্রে স্বীয় দক্ষতা, প্রতিভা ও প্রজ্ঞার বলে ১৮৮৪ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সে মিডভেল কোম্পানিতে প্রধান প্রকৌশলী পদে উন্নীত হন। উল্লেখ্য বৈকালিন সময়ে লেখাপড়া করে ইতোমধ্যে তিনি ম্যাকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি লাভ করেন। ১৮৯০ সালে তিনি মিডভেল কোম্পানি থেকে ইস্তফা দেন এবং ১৯০০ সাল পর্যন্ত Consulting Engineer হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন । জীবনের বাকি সময়টা তিনি বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা তত্ত্বের উদ্ভাবন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাঁর নতুন চিন্তাধারার প্রয়োগে অবৈতনিক পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন ও নতুন ধারণার প্রবক্তা হিসেবে কাজ করেছেন। যা পরিণামে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা (Scientific Management) নামে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তী সময়ে অনেক গবেষক ও ব্যবস্থাপনা বিশারদ তার প্রদত্ত ধারণা নিয়ে বিশ্লেষণ ও এর উন্নয়ন সাধন করলেও বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার জনক (Father of Scientific Management) হিসেবে তিনি ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন । ১৯১৫ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন । 

অবদান (Contributions) : ফ্রেডারিক উইন্সলো টেলর সাধারণ শিক্ষানবীস থেকে প্রধান প্রকৌশলী পর্যন্ত বিভিন্ন পদে দীর্ঘ দু'যুগ দায়িত্ব পালন করেছেন। এতে তাঁর কাছে শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সমস্যা ধরা পড়ে। তিনি এ সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার পর তা সমাধানের পন্থা কী হতে পারে এ নিয়ে দীর্ঘ দুই দশক বিভিন্ন গবেষণাকর্ম পরিচালনা করেন। এভাবেই তিনি তাঁর গবেষণাকর্মের ফলাফলকে একটা দর্শনে রূপ দেন । যা বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা (Scientific Management) নামে পরিচিত। এরূপ ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে তাঁর অবদানসমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলো :

ক) গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা (Writing books and articles): টেলর গবেষণাকর্ম পরিচালনার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার ভাবনাকে সাধারণ্যে তুলে ধরার জন্য বিভিন্ন গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেন। যার মধ্যে The Principles of Scientific Management অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। এ ছাড়াও Shop Management, A Piece Rate System. The Gospel of Efficiency ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য । যা তাঁর দর্শনকে পরবর্তী গবেষণার বিষয়বস্তু হতে ও স্থায়ী রূপ পরিগ্রহে সহায়তা করেছে। তিনি তাঁর চিন্তাধারায় বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপকে একটা মানসিক বিপ্লব হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যা গতানুগতিক ব্যবস্থাপনা ধারণা থেকে ব্যবস্থাপনাকে বেরিয়ে আসতে সুযোগ করে। দিয়েছে।

খ) বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার আদর্শ উপস্থাপন (Introducing scientific management principle) : টেলর তাঁর গবেষণাকর্মের মধ্য দিয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার দু'টি দিক; মানবীয় দিক (উত্তম কর্মী নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি) ও বস্তুগত দিক (পরিকল্পনা, কারখানা পরিবেশ ইত্যাদি) নির্দেশ করেন ও তার উন্নয়নের উপায় নির্দেশ করেন । সেই সাথে তিনি এরূপ ব্যবস্থাপনার কতিপয় আদর্শ তুলে ধরেন; যা নিম্নরূপঃ

১. টিপসহির পদ্ধতি (গতানুগতিক হাতুড়ে পদ্ধতি) পরিহারপূর্বক মানুষের প্রতিটা কাজে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যবহার করা;

২. বৈজ্ঞানিক উপায়ে কর্মী নির্বাচন, প্রশিক্ষণদান ও তাদের উন্নয়ন সাধন করা; 

৩. সৌহার্দ্যপূর্ণ শ্রম-ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা; ও

৪. ব্যবস্থাপনা ও শ্রমিক-কর্মীদের মধ্যে দায়িত্ব ও কর্তব্যের সুষ্ঠু বণ্টন ।

গ) গবেষণা ও কর্ম পদ্ধতির উন্নয়ন (Research and developing working procedure) : টেলর তাঁর বাস্তব উপলব্ধি ও গবেষণাকর্মের মধ্য দিয়ে ব্যবস্থাপনা কর্ম সম্পাদনের অনেকগুলো সহায়ক উপাদান (Elements) বা পদ্ধতি (Mechanism)-এর উদ্ভাবন করেছেন। যা ব্যবস্থাপনা কাজকে অধিক কর্মক্ষম ও ফলদায়ক করতে সমর্থ হয়েছে। এর মধ্যে নিম্নোক্ত উপাদানসমূহ উল্লেখযোগ্য :
১. সময় নিরীক্ষা;

২. গতি নিরীক্ষা;

৩. শ্রান্তি নিরীক্ষা;

৪. কার্যভিত্তিক ফোরম্যানশীপ বা সংগঠন;

৫. পরিকল্পনার জন্য পৃথক কক্ষ বা বিভাগ;

৬. ব্যবস্থাপনায় ব্যতিক্রম আদর্শের অনুসরণ;

৭. কলকব্জা ও যন্ত্রপাতির বিনির্দিষ্ট মান প্রতিষ্ঠা;

৮. স্লাইড রুল এবং সমজাতীয় শ্রম-সংক্ষেপ যন্ত্রপাতির ব্যবহার;

৯. শ্রমিকদের জন্য নির্দেশ কার্ড প্রণয়ন;

১০. পার্থক্যমূলক ঠিকা মজুরি হার ব্যবস্থার প্রবর্তন; 

১১. সকল কার্যের জন্য বোনাস পদ্ধতির প্রবর্তন এবং

১২. উৎপাদনে ব্যবহৃত কলকব্জা ও উৎপাদিত পণ্যের শ্রেণিবিন্যাসে নিমোনিক (Mnemonic) পদ্ধতির উদ্ভাবন ।

ঘ) মানব সম্পদের উপর গুরুত্বারোপ (Providing importance on human resources) : টেলর যদিও তাঁর গবেষণার মধ্য দিয়ে কার্যক্ষেত্রে পদ্ধতিগত উন্নয়ন সাধন করে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির কথা বলেছেন তবে তিনি কোনোভাবেই প্রতিষ্ঠানে মানবশক্তির গুরুত্বকে ছোট করে দেখেননি । তিনি অকপটে বিশ্বাস করতেন বস্তুগত সম্পদের সদ্ব্যবহারের মূলেই রয়েছে মানুষের মানবিক প্রচেষ্টার প্রয়োগ । তিনি আরো লক্ষ করেন যে, মানুষের প্রচেষ্টা যতো বাড়ে সম্পদও ততোই বৃদ্ধি পায়। এ জন্যই তিনি সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেছেন, “বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত ব্যক্তিদের মানসিক বিপ্লবের সঙ্গে জড়িত । আর এটি হলো কাজের প্রতি, সহকর্মীদের প্রতি এবং কর্মকর্তাদের প্রতি তাদের মনোভঙ্গির আমূল পরিবর্তন।" আর এভাবেই নতুন চিন্তাগত ও পদ্ধতিগত উন্নয়নের মধ্য দিয়ে টেলর ব্যবস্থপনার জগতে নতুন এক দিগন্তের সৃষ্টি করেছেন । যা তৎকালীন সময়েই শুধু নয় বর্তমানকাল অবধি ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে রয়েছে।

Content added || updated By

ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে হেনরি ফেয়লের অবদান

হেনরি ফেয়ল (১৮৪১-১৯২৫)

জীবন বৃত্তান্ত (Bio-data) : ব্যবস্থাপনা চিন্তার জগতে সবচেয়ে খ্যাতিমান ইউরোপীয় পণ্ডিত হলেন হেনরি ফেয়ল। ১৮৪১ সালে তিনি তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৪৭ সালে ছয় বৎসর বয়সে বাবা-মার সাথে তিনি ফ্রান্সে চলে আসেন এবং সেখানেই তাঁর পরিবার স্থায়ী আবাস গড়ে তোলে। ১৮৬০ সালে তিনি এস.এ. কমেনট্রি ফোরচ্যামবোল্ট (S.A. Commentary Fourchambault)-এর একটি খনিতে প্রকৌশলী হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৮৮৮ সালে তাঁকে এ খনি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। এরূপ দায়িত্ব গ্রহণকালে এ প্রতিষ্ঠানটি অনেকটা দেউলিয়ার পর্যায়ে ছিল। ১৯১৮ সালে তিনি যখন এ দায়িত্ব থেকে অবসর নেন তখন তার স্বীয় যোগ্যতাবলে এ প্রতিষ্ঠানটি আর্থিকভাবে ছিল যথেষ্ট সচ্ছল ।

ফেয়ল প্রদত্ত ব্যবস্থাপনা তত্ত্ব হলো সর্বপ্রথম ও পূর্ণাঙ্গ উপস্থাপিত তত্ত্ব। তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত এই তত্ত্ব প্রমাণসিদ্ধ উপাদান, কার্যক্রম এবং যাবতীয় কলা-কৌশলকে অন্তর্ভুক্ত করেছে । আধুনিক ব্যবস্থাপনা চিন্তাধারার মূল স্থপতি হিসেবে তাঁর অবদান ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । এ জন্যই তাঁকে আধুনিক ব্যবস্থাপনা তত্ত্বের জনক (Father of Modern Management Thougts) নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে । ১৯২৫ সাথে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ।

অবদান (Contributions) : ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে বিংশ শতকের শুরুতে যে ক'জন ব্যক্তি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন হেনরি ফেয়লের নাম তার মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য । ফ্রান্সের অধিবাসী এ খনি প্রকৌশলী ব্যবস্থাপনাকে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও কাজ সম্বলিত এবং বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত, সর্বজনীনভাবে প্রয়োগযোগ্য ও পাঠযোগ্য শাস্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এজন্য তিনি গবেষণা করেছেন, গবেষণালব্ধ জ্ঞানকে কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন এবং লেখনীর মাধ্যমে তা তুলে ধরেছেন। কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান গঠন, তত্ত্বের উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে তত্ত্বকে তুলে ধরতে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন । তাঁর এই ভূমিকা তাকে আধুনিক ব্যবস্থাপনার জনক হিসেবে মর্যাদার আসনে আসীন করেছে। সুদীর্ঘ কর্মময় জীবনের অধিকারী এই প্রথিতযশা ব্যক্তিত্বের অবদান নিম্নের ছকে তুলে ধরা হলো :

১. শাস্ত্র হিসেবে ব্যবস্থাপনাকে প্রতিষ্ঠা;

২. সর্বজনীন প্রয়োগযোগ্য বিষয় হিসেবে শাস্ত্রের উপস্থাপনা;

৩. শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাজ নির্দিষ্টকরণ;

৪. ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ার কাজ নির্দিষ্টকরণ;

৫. ব্যবস্থাপনার নীতিমালা নির্দেশ;

৬. প্রতিটা কাজে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সম্পর্কে আলোকপাত;

৭. ব্যবস্থাপকীয় যোগ্যতা সম্পর্কে নির্দেশ ও

৮. গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান গঠন ও তত্ত্বের স্বীকৃতি আদায় 

উপরের ছকে উল্লেখ অবদানসমূহ নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:

১. শাস্ত্র হিসেবে ব্যবস্থাপনাকে প্রতিষ্ঠা (Establishing management as a subject): ইতিহাস, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি ইত্যাদির ন্যায় ব্যবস্থাপনাও একটা শাস্ত্র বা বিষয়-এ বিষয়টি সর্বপ্রথম জনসমক্ষে তুলে ধরেন হেনরি ফেয়ল । ১৯১৬ সালে ফ্রেন্স ভাষায় লিখিত তাঁর গবেষণালব্ধ গ্রন্থ Administration industriélé ét général ১৯৪৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে General and Industrial Management নামে প্রকাশিত হয় । যা মার্কিনমুলুকে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে । এতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন যে, ব্যবস্থাপনা জ্ঞানের একটা পৃথক শাখা, সর্বত্র প্রয়োগযোগ্য একটা পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ্যক্রমে ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে পাঠদান সম্ভব । এ জন্যই তিনি ব্যবস্থাপনার কাজ, মূলনীতি, শিল্প প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম, ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ও কর্তব্য ইত্যাদি বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন এবং পরবর্তী আলোচনা ও গবেষণার দুয়ার খুলে দিয়েছেন । যার পথ ধরে ব্যবস্থাপনা আজ একটা সমৃদ্ধ শাস্ত্রের মর্যাদা লাভ করেছে ।

২. সর্বজনীন প্রয়োগযোগ্য বিষয় হিসেবে শাস্ত্রের উপস্থাপন (Presenting the subject as an universal application): হেনরি ফেয়ল ব্যবস্থাপনাকে শুধুমাত্র ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট শাস্ত্র হিসেবে নয়, এটাকে সর্বজনীন বিষয় হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন । তিনি বলেছেন, গৃহস্থালী থেকে শুরু করে সামাজিক, ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয়সহ সকল ধরনের প্রতিষ্ঠানে এরূপ শাস্ত্রের জ্ঞান প্রয়োগ সম্ভব এবং সবাই এ শাস্ত্র অধ্যয়ন করে উপকৃত হতে পারে । দু'হাজার বছর পূর্বে গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস ব্যবস্থাপনাকে যে সর্বজনীনতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছিলেন হেনরি ফেয়ল তাঁর লেখনীর মাধ্যমে সেই বিষয়টিকেই প্রতিষ্ঠা করেছেন ।

৩. শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাজ নির্দিষ্টকরণ (Specifying the activities of industrial establishment): একটা শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাজ কী হতে পারে তা তিনি নির্দিষ্ট করার প্রয়াস পেয়েছেন। এথেকে কাজের বিভাগীয়করণ সম্পর্কে তাঁর চিন্তার প্রমাণ মিলে । তিনি মনে করেছেন, শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাজকে ছয়টা স্বতন্ত্র অংশে ভাগ করা যেতে পারে । সেই সঙ্গে তিনি উক্ত বিভাগের কাজ, দায়িত্ব ও কর্তব্য কি হতে পারে তারও দিক- নির্দেশ করেছেন । এজন্য তাঁকে ব্যবস্থাপনার কার্যভিত্তিক মতবাদের উদ্ভাবক বলা হয়ে থাকে । তাঁর নির্দেশিত কাজসমূহ নিম্নরূপ :

১. কারিগরি কার্যাবলি (উৎপাদন, নির্মাণ, সংযোজন);

২. বাণিজ্যিক কার্যাবলি (ক্রয়, বিক্রয়, বিনিময়);

৩. অর্থ সংক্রান্ত কার্যাবলি (মূলধনের অনুসন্ধান ও এর কাম্য ব্যবহার);

৪. নিরাপত্তা কার্যক্রম (সম্পত্তি ও ব্যক্তির রক্ষণাবেক্ষণ);

৫. হিসাবরক্ষণ; (জমা-খরচ, মূল্য, পরিসংখ্যান) ও ৬. ব্যবস্থাপনা (পরিকল্পনা, সংগঠন, আদেশ, সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ) ।

৪. ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ার কাজ বা উপাদানসমূহ নির্দিষ্টকরণ (Specifying the functions or elements of management process): ব্যবস্থাপনার কাজ কি এ বিষয়ে পরবর্তী সময়ের ব্যবস্থাপনা বিশারদগণ ব্যাপক চিন্তা-গবেষণা করলেও সর্ব প্রথম হেনরি ফেয়ল এর পাঁচটি কাজ নির্দিষ্ট করেন; যা অদ্যাবধি ব্যবস্থাপনার মূল কাজ হিসেবেই বিবেচিত হয়ে এসেছে। তিনি বলেছেন, "To manage is to forecast and plan, to organise, to command, to coordinate and to control." অর্থাৎ ব্যবস্থাপনা হলো পূর্বানুমান ও পরিকল্পনা, সংগঠন, আদেশদান, সমন্বয়সাধন ও নিয়ন্ত্রণ করা ।

৫. ব্যবস্থাপনার নীতিমালা নির্দেশ (Indicating the principles of management): প্রতিটা বিষয় সংশ্লিষ্ট কতকগুলো মূলনীতি থাকে । যে নীতির আলোকে শাস্ত্র সংক্রান্ত চিন্তা-ভাবনা বিকশিত হয় । ফেয়ল সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই ব্যবস্থাপনার ১৪টি মূলনীতি উপস্থাপন করেছিলেন- যা অদ্যাবধি ব্যবস্থাপনা চিন্তাধারায় পরীক্ষিত সত্য হিসেবে প্রয়োগযোগ্য বিবেচিত হচ্ছে । এ বিষয়ে ব্যবস্থাপনার নীতি বা আদর্শ শিরোনামে তা পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।

৬. প্রতিটা কাজে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সম্পর্কে আলোকপাত (Focusing the responsibility management in every organisational function) : ফেওল ব্যবস্থাপনার কাজই শুধু নির্দিষ্ট করেননি এ সকল কাজে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব কী সেই নিয়েও বিশদ আলোচনা করেছেন। তিনি একজন সংগঠক বা ব্যবস্থাপকের ১৬টি ব্যবস্থাপনাগত দায়িত্বের কথা বলেছেন; যা নিম্নরূপ:

১. বিচক্ষণভাবে পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা;

২. প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য, সম্পদ ও প্রয়োজনের সঙ্গে নিয়োজিত জনশক্তি ও উপকরণ সঙ্গতিপূর্ণ কি না তা দেখা;

৩. একটি একক, দক্ষ ও শক্তিশালী কর্তৃত্বকাঠামো স্থাপন করা;

৪. বিভিন্ন কাজ এবং প্রচেষ্টার সমন্বয়সাধন করা; 

৫. পরিষ্কার, স্পষ্ট এবং যথাযথ সিদ্ধান্ত প্রণয়ন করা;

৬. দক্ষ কর্মী নির্বাচন এবং সঠিক স্থানে নিয়োগের ব্যবস্থা করা;

৭. দায়িত্ব স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়ন করা;

৮. উদ্যোগ গ্রহণ এবং দায়িত্ব পালন করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে উৎসাহিত করা;

৯. প্রদত্ত সেবার জন্য ন্যায়সঙ্গত ও উপযুক্ত পারিশ্রমিক প্রদান করা; 

১০. দোষ-ত্রুটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান প্রয়োগ করা;

১১. শৃঙ্খলা রক্ষিত হচ্ছে কি না তা দেখা;

১২. সাধারণ স্বার্থকে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান প্রদান নিশ্চিত করা;

১৩. আদেশের ঐক্যের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া;

১৪. বৈষয়িক এবং মানবিক দু'ধরনের উদ্দেশ্য অর্জন তত্ত্বাবধান করা; 

১৫. প্রত্যেক কাজকে নিয়ন্ত্রণে রাখা; ও

১৬. নিয়মকানুনের বাড়াবাড়ি বা লালফিতার দৌরাত্ম্য এবং কাগুজে নিয়ন্ত্রণ প্রতিরোধ করা ।

৭. ব্যবস্থাপকীয় গুণ সম্পর্কে নির্দেশ (Indicating the managerial quality): হেনরি ফেয়ল ব্যবস্থাপকদের কাজ ও দায়িত্ব ছাড়াও ব্যবস্থাপকদের যোগ্যতা ও জ্ঞান সম্পর্কেও দিক-নির্দেশ করেছেন । তাঁর মতানুসারে একজন ব্যবস্থাপকের নিম্নোক্ত যোগ্যতা ও জ্ঞান থাকা আবশ্যক :
ক) স্বাস্থ্য ও শারীরিক সক্ষমতা;

খ) বুদ্ধিমত্তা ও মানবিক শক্তি;

গ) নৈতিক গুণাবলি;

ঘ) সাধারণ শিক্ষা;

ঙ) বাণিজ্যিক, কারিগরি ও অন্যান্য কাজ সংক্রান্ত জ্ঞান এবং 

চ) প্রতিষ্ঠানের বৈশিষ্ট্য সংশ্লিষ্ট অন্য কোনো বিশেষ জ্ঞান ।

৮. গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান গঠন ও তত্ত্বের স্বীকৃতি আদায় (Forming research organisation and acquiring the acceptance of concept) : হেনরি ফেয়ল তাঁর প্রশাসনিক তত্ত্বের উন্নয়ন ও জনপ্রিয় করার জন্য দু'টি বিশেষ কার্যক্রম পরিচালনা করেন । যা তত্ত্বের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে পরবর্তীতে ভূমিকা রেখেছে । যা নিম্নরূপ :

ক) প্রশাসনিক শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা (Establishing centre for administrative studies): তিনি তাঁর প্রশাসনিক তত্ত্বের উন্নয়নের জন্য Centre of Administrative Studies প্রতিষ্ঠা করেন । সেখানে তিনি লেখক, দার্শনিক, প্রকৌশলী, শিল্পপতিসহ বিভিন্ন পেশার লোকদের নিয়ে সাপ্তাহিক সভার ব্যবস্থা করতেন । এসব সভায় তিনি সভাপতিত্ব করতেন। এই কেন্দ্রের প্রচেষ্টায় ফেয়লবাদ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

খ) তত্ত্বের প্রসারে ব্যবস্থা গ্রহণ (Taking steps for widening concept): তিনি তাঁর নির্দেশিত নীতিমালা অনুসরণের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপের জন্য ফ্রান্সের সরকারকে উৎসাহিত করার চেষ্টা চালান । ১৯২৩ খিস্টাব্দে ব্রাসেসে অনুষ্ঠিত প্রশাসনিক বিজ্ঞানের উপর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে তিনি নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখেন । ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘের অধিবেশনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রশাসনিক তত্ত্বের গুরুত্বের উপর বক্তৃতা প্রদান করেন । এভাবেই তিনি প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার প্রসার ও উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন ।

উপসংহারে বলা যায়, ব্যবস্থাপনা বিষয়কে হেনরি ফেয়ল যেভাবে বুঝেছিলেন, যেভাবে একে শাস্ত্র হিসেবে চিন্তা ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সবার জন্য উপযোগী শাস্ত্র ও পাঠ্য বিষয় হিসেবে দাঁড় করিয়েছিলেন সেজন্য ইতিহাসে তিনি আধুনিক ব্যবস্থাপনা তত্ত্বের জনক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা তত্ত্বের উদগাতা হিসেবে স্থান করে নিয়েছেন । আধুনিক বিশ্ব সভ্যতা যতদিন টিকে থাকবে ততদিন হেনরি ফেয়লের নাম ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের ইতিহাসে উজ্জ্বল ও ভাস্বর হয়ে থাকবে ।

Content added By

আদর্শ ব্যবস্থাপকের দক্ষতা

মি. সাইফুল সানমুন গ্রুপের একটা শিল্প ইউনিটের ব্যবস্থাপক । ব্যক্তিগতভাবে তার কিছু বিষয়ে সমস্যা থাকলেও বিভাগগুলোকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করেন । ফলে তার শিল্প ইউনিটটি ভালো মুনাফা করছে । অন্যদিকে মি. শরিফুল আরেকটি শিল্প ইউনিটের ব্যবস্থাপক । তিনি সৎ ও উত্তম স্বভাবের মানুষ। কিন্তু তার অধীনস্ত বিভাগগুলো তিনি সঠিকভাবে চালাতে ব্যর্থ হচ্ছেন । অধস্তনরা সন্তুষ্ট থাকলেও শিল্প ইউনিটটি প্রত্যাশিত মুনাফা করতে পারছে না । মাঝে মধ্যে মি. সাইফুল সম্পর্কে কিছু অভিযোগ হেড অফিসে আসলেও মালিক পক্ষ তার ওপর সন্তুষ্ট । এক্ষেত্রে ব্যবস্থাপক হিসেবে কে দক্ষ এ বিচারে মি. সাইফুল নিশ্চয়ই এগিয়ে থাকবেন । কারণ ব্যক্তি হিসেবে কিছু দুর্বলতা থাকলেও ব্যবস্থাপক হিসেবে তিনি ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য অর্জনে সফলতার পরিচয় দিতে পারছেন । তাই যাকে যেখানে যে উদ্দেশ্যে কাজ দেয়া হয়েছে তিনি সেটা কতটা সাফল্যের সাথে পালন করতে পারছেন তার ওপরই ব্যবস্থাপকের কার্যদক্ষতা নির্ভরশীল ।

সঠিক সময়ে, সঠিকভাবে ও কম খরচে প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারাই হলো দক্ষতা । ব্যবস্থাপকের দক্ষতা বলতে একজন ব্যবস্থাপকের ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট কাজগুলো সঠিকভাবে ও সঠিক সময়ে যোগ্যতার সঙ্গে এবং স্বল্প ব্যয়ে সম্পাদন করার সামর্থ্যকে বুঝায় । ন্যূনতম শক্তি, অর্থ, সামর্থ্য ও সম্পদকে কাজে লাগিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনের বিষয়টি তাই একজন ব্যবস্থাপকের দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল । ব্যবস্থাপকের এরূপ দক্ষতা তার কতিপয় জ্ঞান, গুণ ও সামর্থ্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত। যার বিবেচনায় একজন ব্যবস্থাপকের কতিপয় গুণ বা দক্ষতা প্রতিষ্ঠানের দক্ষতাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। যেই ব্যবস্থাপক যতবেশি সবগুলো দক্ষতা অর্জন করতে পারেন ততই তিনি আদর্শ ও দক্ষ ব্যবস্থাপক হিসেবে গণ্য হন । একজন আদর্শ ব্যবস্থাপকের যে সকল দক্ষতা থাকতে হয় তা নিম্নে আলোচনা করা হলো :

১. কারিগরি দক্ষতা (Technical skill) : প্রতিটা কাজ সম্পাদনে যে পদ্ধতি, কৌশল বা যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হয় তা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারা কারিগরি দক্ষতা হিসেবে গণ্য। প্রতিটা কাজের সাথেই কমবেশি কারিগরি দক্ষতার প্রয়োজন পড়ে । কম্পিউটারে একজন কর্মী কাজ করছে । এর সংশ্লিষ্ট প্রতিটা বিষয় কর্মীর জানা থাকলে সে যেভাবে দ্রুত কাজটা করতে পারবে আরেকজন কম জানা কর্মীর পক্ষে তা সম্ভব হবে না । এক্ষেত্রে পার্থক্যই হলো কারিগরি দক্ষতা । একজন উকিল একটা কেস যেভাবে সুন্দর করে সাজান ও বক্তব্য তুলে ধরেন আরেকজন সেভাবে পারে না । এক্ষেত্রে পার্থক্য কারিগরি দক্ষতার । কোনো যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জ্ঞান যেমনি কারিগরি দক্ষতা তেমনি কোম্পানির হিসাব সংরক্ষণ, উদ্বৃত্তপত্র (Balance sheet) তৈরি, হিসাব নিরীক্ষার জ্ঞানও কারিগরি দক্ষতার আওতাধীন ।

২. মানবীয় বা আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা (Human or Interpersonal skill) : মানুষের সাথে মিশতে পারার এবং মানুষকে উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করে কাজ আদায় করতে পারার দক্ষতাকেই মানবীয় বা আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা বলে । এক্ষেত্রে ব্যক্তি বা দলকে বুঝে সেভাবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা, নিজস্ব চিন্তার প্রতি তাদের সমর্থন আদায় এবং প্ররোচিত ও উৎসাহিত করার সামর্থ্য গুরুত্বপূর্ণ । ব্যবস্থাপনার কাজ মূলত মানুষ চালানো। প্রতিষ্ঠানের ভিতরে ও বাইরে বিভিন্ন মানুষের সাথে ব্যবস্থাপককে মিশতে হয়, মতবিনিময় করতে হয় । তাদের প্রত্যাশা ও সমস্যা বুঝতে হয়, তাদের মনের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করে নিজের কাজটা করিয়ে নিতে হয় । তাই ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে মানবীয় দক্ষতা খুবই আবশ্যক বিবেচিত হয়ে থাকে ।

৩. ধারণাগত বা কল্পনা সংক্রান্ত দক্ষতা (Conceptual skill) : ভবিষ্যৎ অবস্থা বা পরিস্থিতি সম্পর্কে আগাম ধারণা করতে পারার সামর্থ্যকেই ব্যবস্থাপকের কল্পনা সংক্রান্ত দক্ষতা বলে । একজন ব্যবস্থাপকের প্রথম কাজই হলো পরিকল্পনা গ্রহণ । এই পরিকল্পনা গ্রহণ পূর্বানুমানের সাথে সম্পৃক্ত। সঠিকভাবে পূর্বানুমান করে পরিকল্পনা গ্রহণ, সিদ্ধান্ত প্রদান ইত্যাদি তাই ব্যবস্থাপকের কল্পনা সংক্রান্ত দক্ষতার সাথে সম্পৃক্ত । আগাম কোনো বিষয়ে ধারণা করতে পারাই শুধু নয় উদ্ভূত অবস্থায় কী ধরনের কার্য ব্যবস্থা গ্রহণ করলে সর্বোচ্চ সুফল লাভ করা যাবে এ বিষয়ে ধারণা করতে পারাও এরূপ দক্ষতার অন্তর্ভুক্ত । প্রয়োজনীয় নীতি-কৌশল নির্ধারণ, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয় বিধায় প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পর্যায়ের নির্বাহীদের এ ধরনের দক্ষতার অধিক প্রয়োজন পড়ে ।

৪. সমস্যা অনুধাবনের দক্ষতা (Diagnostic skill) : কোনো সমস্যা ও এর প্রকৃতি দ্রুত আঁচ করতে পারার সামর্থ্যকেই সমস্যা অনুধাবনের দক্ষতা বলে। একটা প্রতিষ্ঠান চালাতে যেয়ে ব্যবস্থাপকদেরকে প্রতিনিয়তই ছোট বড় নানান ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়। সমস্যার প্রকৃতি এমন যে, এটাকে বুঝে শুরুতেই তা সমাধা করা গেলে ভবিষ্যতে সেটি বড় বিড়ম্বনার কারণ হতে পারে না। একজন ডাক্তার যদি রোগীর রোগকে শুরুতেই সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারেন তবে রোগ নিরাময়ে তা যেমনি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে একজন ব্যবস্থাপকের ক্ষেত্রেও সেভাবে প্রতিষ্ঠানের সমস্যাগুলো দ্রুত শনাক্ত করতে পারার দক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয় । এরূপ সমস্যা বোঝার সাথে সমাধানের পন্থা বা করণীয় নির্ধারণের বিষয়ও এরূপ দক্ষতার অধীন। প্রতিষ্ঠানের উচ্চ ও মধ্য পর্যায়ের ব্যবস্থাপকের জন্য এরূপ দক্ষতার অধিক প্রয়োজন পড়ে ।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, একটা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবস্থাপকদের বিভিন্ন পরিমাণের কারিগরি, মানবীয় ও ধারণাগত জ্ঞান বা দক্ষতা থাকতে হয়। প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মরত ব্যবস্থাপকদের বিভিন্ন ধরনের দক্ষতা কতটা থাকা আবশ্যক তা নিম্নের রেখাচিত্রে প্রদর্শিত হলো :

চিত্র : ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন পর্যায়ে আবশ্যক দক্ষতাসমূহ
Content added || updated By

আদর্শ ব্যবস্থাপকের গুণাবলি

বর্তমানকালে প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত উপায়-উপাদানের মধ্যে দক্ষ ব্যবস্থাপনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে সকল মহলেই স্বীকৃত । একই স্থানে একই পরিমাণে অর্থ ও উপাদান বিনিয়োগের পরও দু'জন ব্যবসায়ীর মধ্যে সফলতা অর্জনে যে পার্থক্য লক্ষ করা যায় তার মধ্যে মূল পার্থক্য নির্ধারণকারী উপাদান হলো ব্যবস্থাপকের গুণাবলির ভিন্নতা । ব্যবসায়ের সফলতার জন্য একজন ব্যবস্থাপকের যে সকল গুণ কম-বেশি থাকা উচিত তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো :

১. সাধারণ শিক্ষা ও জ্ঞান (General education and knowledge) : বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানের একজন ব্যবস্থাপককে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করতে হলে তার উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ও জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া উচিত । সাংগঠনিক পরিচালনা সম্পর্কিত জ্ঞান একজন ব্যবস্থাপককে তার কাজ সঠিকভাবে সম্পাদনে সহায়তা করে ।

২. অভিজ্ঞতা (Experience) : অভিজ্ঞতা বলতে কাজের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকে অর্জিত ও লব্ধ জ্ঞানকে বুঝায় । ব্যবস্থাপনা একদিকে কলা ও অন্যদিকে বিজ্ঞান। তাই কলা হিসেবে একজন ব্যবস্থাপকের প্রায়োগিক অভিজ্ঞতা থাকা অপরিহার্য। বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা ও কার্যকলাপের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা একজন ব্যবস্থাপককে পূর্ণতা দান করে । শিক্ষিত কম হওয়ার পরও যারা ব্যবসায়ে ভালো করছেন, এটা সম্ভব হয়েছে তাদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কারণেই ।

৩. শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্য (Physical and mental abilities) : শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা, শক্তি ও দৃঢ়তাকে এ ধরনের যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয় । একজন ব্যবস্থাপককে বিশেষত শীর্ষ নির্বাহীদের ক্ষেত্রবিশেষে ২৪ ঘন্টা কাজ করতে হয় । তাই কর্তব্য কাজে তাদের যথেষ্ট পরিশ্রমী হওয়া আবশ্যক । সেই সাথে নানা প্রতিকূল অবস্থা ও ঝামেলার মধ্যে তাকে চলার জন্য যথেষ্ট মানসিক ভারসাম্যপূর্ণ ও দৃঢ় হওয়ার প্রয়োজন পড়ে । অন্যথায় দক্ষতার সাথে ব্যবস্থাপনা কার্য পরিচালনা তার পক্ষে সম্ভব হয় না ।

৪. আন্তরিকতা ও সংকল্পবদ্ধতা (Sincerity and determination) : কোনো কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং কর্তব্য-কাজে একাগ্র ও মনোযোগী হলে তাকে আন্তরিকতা বলে । একজন ব্যবস্থাপক যদি তার কর্তব্য কাজে আন্তরিক না হয় এবং কাজের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে না পারে তবে তার পক্ষে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া সম্ভব নয় । সেই সাথে একজন ব্যবস্থাপক এ পেশায় ব্যক্তিক উন্নয়নের ব্যপারে সংকল্পবদ্ধ না হলে তার পক্ষে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া সম্ভব হয় না । এরূপ গুণ থাকলে অনেক কম যোগ্য ব্যক্তিও নিজস্ব পেশায় ভালো করতে পারে ।

৫. যোগাযোগ দক্ষতা (Communicative skill) : অন্যের বা অন্যদের নিকট সঠিক সময়ে সঠিক উপায় বা পদ্ধতিতে নিজের বক্তব্য কার্যকরভাবে তুলে ধরে উদ্দেশ্য অর্জনের সামর্থ্যকে যোগাযোগ দক্ষতা বলে । বিভিন্ন পক্ষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা ও কাজ আদায়ে একজন ব্যবস্থাপকের যোগাযোগ দক্ষতা থাকতে হয় । যে ব্যবস্থাপক সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সাথে যতবেশি যোগাযোগ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেন কার্যক্ষেত্রে তার পক্ষেই ততবেশি কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়ে থাকে । তাই সকল অবস্থায় যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যমে সঠিক তথ্য জানা ও জানানো এবং সহজে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে লক্ষ্যার্জনের গুণ ব্যবস্থাপকের থাকা উচিত ।

৬. অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা (Power to motivate) : অনুপ্রাণিত করা বলতে অন্যদেরকে উৎসাহিত, শক্তি সঞ্চারিত ও কাজে উদ্দীপ্ত করাকে বুঝায় । ব্যবস্থাপনার কাজ হলো অন্যদের দ্বারা প্রয়োজনীয় কাজ সম্পাদন করিয়ে নেয়া । এরূপ কাজ সম্পাদনের নিমিত্তে সংশ্লিষ্টদের অনুপ্রাণিত করা অপরিহার্য । তাই সহজে প্রতিষ্ঠানের ভিতরে ও বাইরে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষকে অনুপ্রাণিত ও প্ররোচিত করার ক্ষমতা ব্যবস্থাপকের একটি অন্যতম গুণ হিসেবে বিবেচিত ।

৭. প্রজ্ঞা বা দূরদর্শী (Fore-sight) : জ্ঞানচক্ষু বা বিশেষ জ্ঞান দ্বারা ভবিষ্যৎকে উপলব্ধি বা বুঝতে পারার সামর্থ্যকে প্রজ্ঞা বা দূরদর্শী বলে । একজন ব্যবস্থাপককে সব সময়ই পূর্বানুমানের ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নিতে হয় । তাই ব্যবস্থাপক যদি বর্তমান অবস্থা ও পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সঠিক অনুমান করতে ব্যর্থ হয় তবে তার পক্ষে কার্যকর পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না । একজন দূরদর্শী প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি যোগ্য ও সফল ব্যবস্থাপক হিসেবে সহজেই প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে ।

৮. তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা (Sharp intelligence) : বোধশক্তি, বিচারশক্তি, জ্ঞান ও মেধাশক্তির সম্মিলিত রূপকে বুদ্ধিমত্তা বলে । একজন ব্যবস্থাপককে সকল অবস্থায় সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্রুত সামনে এগিয়ে যেতে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী হওয়া প্রয়োজন । সকল পক্ষের সাথে উত্তম সম্পর্ক বজায় রেখে দ্রুত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তাই প্রয়োজনীয় বুদ্ধিমত্তার অধিকারী হওয়া ব্যবস্থাপকের একটি অন্যতম গুণ ।

৯. সাহসিকতা (Courage) : যে কোনো পরিস্থিতিতে ভীত না হয়ে বুদ্ধিমত্তার সাথে সামনে এগিয়ে যাওয়ার গুণকেই সাহসিকতা বলে । ব্যবসায়ের সাথে ঝুঁকি সব সময়ই জড়িত । যে কোনো নতুন উদ্যোগ ও পরিকল্পনা গ্রহণে ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা বিদ্যমান থাকে । তারপরও ব্যবসায় পরিচালনায় অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক নানারূপ বিপত্তি লক্ষ করা যায় । সকল অবস্থায় দক্ষতার সাথে ব্যবসায় পরিচালনার জন্য অবশ্যই ব্যবস্থাপককে যথেষ্ট সাহসী হতে হয় ।

১০. সংযত ব্যক্তিত্ব (Pleasant personality) : চিন্তা, কথা, কাজ ও আচরণে কোনো ব্যক্তি ভদ্র, মার্জিত, বিনয়ী, দৃঢ় ও আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন হলে অন্যের নিকট ব্যক্তির যে আকর্ষণীয় রূপের বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাকে ব্যক্তিত্ব বলে । বিচিত্র মনের কর্মী ও বিচিত্র পরিবেশের মধ্যেও সবদিক বজায় রেখে চলতে হলে ব্যবস্থাপককে অবশ্যই আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে । যা অন্যদের নিকট ব্যবস্থাপককে আকর্ষণীয় করে তোলে ।

উপসংহারে বলা যায়, অন্যকে দিয়ে পরিকল্পিত উপায়ে যথাযথভাবে কাজ করাতে হলে একজন ব্যবস্থাপকের উপরোক্ত গুণাবলি থাকা আবশ্যক । যে ব্যবস্থাপকের মধ্যে উপরোক্ত গুণাবলির সমাহার বেশি ঘটে কার্যক্ষেত্রে তার পক্ষেই তত বেশি সফলতা অর্জন সম্ভব হয়।

Content added By

আদর্শ ব্যবস্থাপকের ভূমিকা

যে কোনো প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ । ব্যবস্থাপকগণ প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত সকল জনশক্তি ও উপায়-উপকরণকে লক্ষ্যপানে পরিচালিত করেন বা নেতৃত্ব দেন। তাদের সার্বক্ষণিক তৎপরতা বা ভূমিকা প্রতিষ্ঠানকে সবসময় গতিশীল রাখে । পরিকল্পনা তৈরি ও তা বাস্তবায়নের জন্য সংগঠন, কর্মীসংস্থান, নির্দেশনা, প্রেষণা, সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ কার্যে ব্যবস্থাপকগণ সবসময় ব্যাপৃত থাকেন। সীমিত সময়, শক্তি ও অর্থ ব্যয়ে প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত মানবীয় ও বস্তুগত উপকরণাদিকে কাজে লাগানোর জন্য একজন ব্যবস্থাপক সার্বক্ষণিক চেষ্টা চালান । তাই একজন আদর্শ ব্যবস্থাপকের ভূমিকা বা প্রাত্যহিক কাজ প্রতিষ্ঠানে কি হওয়া উচিত এ নিয়ে বিভিন্ন মনীষী গবেষণা চালিয়েছেন । এতে একজন ব্যবস্থাপকের প্রতিদিন তিন ধরনের ভূমিকা মুখ্য বিবেচিত হয়েছে । নিম্নে তা তুলে ধরা হলো:

১. আন্তঃব্যক্তিক ভূমিকা (Interpersonal roles): অন্যের সাথে কথা বলা ও আলাপ-আলোচনা করার কাজকে একজন ব্যবস্থাপকের আন্তঃব্যক্তিক ভূমিকা বলে। একজন ব্যবস্থাপককে ঘুম থেকে উঠার পর থেকে অফিসে যাওয়া বা ঢোকা থেকে শুরু করে বেরিয়ে আসা এমনকি ঘুমাতে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের ভিতরের ও বাইরের বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে কথা বলতে হয় । নির্দেশ-উপদেশ ও পরামর্শ দিতে হয়,তাদের স্বমতে নিয়ে আসতে হয়, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা ও তাদের পরামর্শ গ্রহণ করতে হয় । মাঝে মধ্যেই অধস্তনদের নিয়ে সভা করতে হয় । সমস্যা নিয়ে আলোচনা, পরামর্শ ও সমাধান দেয়ার প্রয়োজন পড়ে । বাইরের বিভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পক্ষের কথা শুনতে হয়, প্রয়োজনে তাদের সাথে যোগাযোগ করতে হয় । এর সবই একজন দক্ষ ব্যবস্থাপকের আন্তঃব্যক্তিক ভূমিকা হিসেবে গণ্য । এরূপ ভূমিকা ব্যবস্থাপকের মানবীয় দক্ষতা, যোগাযোগ দক্ষতা ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে । যদি একজন ব্যবস্থাপক মানুষের সাথে কথা বলতে বিরক্তবোধ করেন, কারও সাথে যোগাযোগ রক্ষায় অনীহায় ভোগেন, বিভিন্ন জনের মোবাইল নম্বর, ই-মেইল নম্বর সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও যোগাযোগে নিরুৎসাহী হন তবে তার পক্ষে এ ধরনের ভূমিকা পালন করা সম্ভব হয় না ।

২. তথ্য সংশ্লিষ্ট ভূমিকা (Informational roles): প্রতিদিন তথ্য সংগ্রহ ও তথ্য প্রদান সংক্রান্ত ব্যবস্থাপকের কাজকেই তথ্য সংশ্লিষ্ট ভূমিকা বলে । বর্তমান যুগকে তথ্যের যুগ বলা হয় । কারণ যার কাছে যত তথ্য থাকে ততই তিনি সমৃদ্ধ বিবেচিত হন । প্রতিষ্ঠানে সমপদে কর্মরত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে যিনি যত তথ্যসমৃদ্ধ কার্যক্ষেত্রে তার পক্ষেই তত সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব । সাধারণ একজন ব্যবস্থাপকের কথাই যদি ধরা যায় তবে দেখা যাবে তাকে সকালে প্রতিষ্ঠানে ঢুকেই সকল কর্মী প্রতিষ্ঠানে এসেছে কি না সে বিষয়ে তথ্য নিতে হয় । কাঁচামাল আসলো কি না, উৎপাদন ঠিকমত হচ্ছে কি না, সমস্যা থাকলে সমস্যার কারণ কী, মাল বিক্রয় হচ্ছে কি না, মজুত কী রয়েছে, গ্রাহকদের প্রত্যাশা কী, তারা কেমন আচরণ করছে, প্রতিযোগীরা কী ধরনের ভূমিকা নিচ্ছে ইত্যাদি নানান তথ্য তার কাছে থাকতে হয় । এরপর ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিবর্গ বা মালিককে বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য দিতে হয় । বাইরের বিভিন্ন পক্ষও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানতে চায় । তাদেরকেও প্রয়োজনে তথ্য সরবরাহের প্রয়োজন পড়ে । এভাবে তথ্য সংগ্রাহক, সংরক্ষক ও প্রচারক হিসেবে একটা প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপকের প্রাত্যহিক ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ।

৩. সিদ্ধান্তমূলক ভূমিকা (Decisional role) : প্রাত্যহিক বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে করণীয় নির্ধারণের কাজকেই ব্যবস্থাপকের সিদ্ধান্তমূলক ভূমিকা বলে । একজন ব্যবস্থাপককে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা করণীয় নির্ধারণ করতে হয়, সিদ্ধান্ত দিতে হয়, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিষয়টি দেখতে হয়, ঊর্ধ্বতন কর্তৃক সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাজে সহযোগিতা করতে হয়, সম্পৃক্ত থাকতে হয়— যার সব কিছুই ব্যবস্থাপকের প্রাত্যহিক সিদ্ধান্তমূলক ভূমিকার মধ্যে পড়ে । একজন উৎপাদন ব্যবস্থাপক সকালে অফিসে যেয়েই শুনলেন তাদের একটা মেশিন কাজ করছে না । মেরামত বিভাগকে জানিয়ে দ্রুত টেকনিশিয়ান আনতে হবে । কাঁচামাল যেটা সরবরাহ করা হয়েছে তা মানসম্পন্ন না হওয়ায় উৎপাদনের মান খারাপ হচ্ছে । করণীয় কী তাকেই সিদ্ধান্ত দিতে হবে। প্রয়োজনে সাধারণ ব্যবস্থাপক থেকে সিদ্ধান্ত জেনে নিতে হবে । বিভাগীয় একজন ফোরম্যান অসদাচরণ করেছে তার বিষয়েও সিদ্ধান্ত দেয়া দরকার । ঊর্ধ্বতনদের দেয়া সিদ্ধান্ত অধস্তনদের জানানো ছাড়াও প্রতিদিন প্রতিনিয়ত একজন ব্যবস্থাপককে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নমূলক নানান কাজে সম্পৃক্ত থাকতে হয়। তাই দ্রুত ও যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে পারার সামর্থ্য একজন ব্যবস্থাপকের অন্যতম গুণ বিবেচিত হয়ে থাকে ।

 

 

Content added By

উপায়-উপকরণাদির কার্যকর ব্যবহার করে লক্ষ্যে পৌছানোর জন্য পরিকল্পনা, সংগঠন, কর্মীসংস্থান, নির্দেশনা, প্রেষণা, সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ কার্যকে ব্যবস্থাপনা বলে । এ ধরনের কাজ যারা সম্পাদন করেন তাদেরকে ব্যবস্থাপক বলা হয়ে থাকে । অন্যদিকে ব্যবস্থাপনার উপরিপর্যায়ে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের প্রয়াস-প্রচেষ্টাকে প্রশাসন বলা হয়ে থাকে । একটা প্রতিষ্ঠানের সংগঠন কাঠামোর বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থাপক কার্য পরিচালনা করেন । স্তরভেদে তাদেরকে উচ্চ, মধ্য ও নিম্ন পর্যায়-এ তিনভাগে ভাগ করা হয় । স্তরীয় পার্থক থাকায় কার্য প্রকৃতিতে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও সকল পর্যায়ের ব্যবস্থাপকগণকেই পরিকল্পনা প্রণয়নসহ সকল ব্যবস্থাপনা কাজ কমবেশি সম্পাদনের প্রয়োজন পড়ে । পরিকল্পনার ক্ষেত্রে উচ্চস্তরের ব্যবস্থাপকগণ দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও নীতি কৌশল নির্ধারণ করেন । অন্যদিকে তা বাস্তবায়নের জন্য মধ্য পর্যায়ের ব্যবস্থাপকগণ বিভাগীয় পরিকল্পনা প্রণয়নসহ নিচের স্তরের ব্যবস্থাপকদের নিকট থেকে কাজ আদায়ে মুখ্য ভূমিকা পালনে সচেষ্ট থাকেন। স্বাতন্ত্র্য নির্ধারণের সুবিধার্থে ব্যবস্থাপনার উচ্চ বা শীর্ষ পর্যায়কে প্রশাসন নামে অভিহিত করা হয় । প্রশাসন হলো একটা দেহের মস্তিস্ক স্বরূপ । কারণ মস্তিস্ক করণীয় নির্ধারণ করে । আর তা বাস্তবায়িত হয় বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে । সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় প্রশাসন মুখ্য করণীয় বা পকিল্পনা ও নীতি কৌশল নির্ধারণ করে আর ব্যবস্থাপনা (মধ্য ও নিম্ন পর্যায়) তা বাস্তবায়ন করে থাকে । এরূপ বিবেচনায় ব্যবস্থাপনা প্রশাসনের অধীন । প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা অধিক মাত্রায় প্রশাসন ভোগ করে এবং সেখান থেকে তা নিচের পর্যায়ের ব্যবস্থাপকদের নিকট ক্রমান্বয়ে ন্যস্ত হয় । একটা বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক পর্যায়ে শীর্ষ নির্বাহীর সংখ্যা কম থাকে কিন্তু ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে ব্যবস্থাপকের সংখ্যা বেশি হয় । প্রশাসনে চিন্তনীয় বা মানসিক শ্রম সম্বলিত কাজ বেশি থাকে সেক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার পর্যায় অনুযায়ী করণীয় (Doing) অর্থাৎ শারিরীক শ্রম নিচের পর্যায়ে বাড়তে থাকে । নিম্নে ব্যবস্থাপনার স্তর ভেদে প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার উপস্থিতি রেখাচিত্রে তুলে ধরা হলো :

চিত্র : প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার পারস্পরিক অবস্থান
Content added By

সংগঠন, ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনের মধ্যে সম্পর্ক

সংগঠন, ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসন একে অন্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। সংগঠন না থাকলে যেমনি ব্যবস্থাপনা বা প্রশাসনের অস্তিত্ব চিন্তা করা যায় না তেমনি ব্যবস্থাপনা বা প্রশাসন ছাড়া সংগঠন কখনই অস্তিত্ব লাভ করে না । তাই অনেকে এদের সবাইকে সমার্থক গণ্য করেন । পরিভাষার দিক বিবেচনা করলে সংগঠন ও ব্যবস্থাপনার পৃথক অস্তিত্ব রয়েছে । প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনাকে ব্যবস্থাপনা পর্যায় বিবেচনায় পৃথকভাবে নির্দিষ্ট করা হলে সেক্ষেত্রেও উভয়ের মধ্যে পৃথক রূপ প্রতিভাত হয় । সম্পর্ক নিরূপণের ক্ষেত্রে প্রতিটা বিষয়ে পৃথক ধারণা নিম্নে তুলে ধরা হলো :

১. সংগঠন (Organization) : প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত উপকরণাদি সংহত ও সমন্বিত করার কৌশলকে সংগঠন বলে । সংগঠনকে প্রতিষ্ঠান অর্থে ধরা হলে-এটি হলো কতিপয় ব্যক্তির সংঘবদ্ধ সম্পর্কের কাঠামো । তাই প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনে কতিপয় ব্যক্তি লক্ষ্যার্জনের জন্য একত্রে কাজ করে । ব্যক্তিবর্গের মধ্যে কেউ ঊর্ধ্বতন ও কেউ অধস্তন হিসেবে সম্পর্কযুক্ত থাকে । প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড যত বাড়ে ব্যবস্থাপনার পর্যায় বা স্তরও ততই বৃদ্ধি পায় । সংগঠনের বা প্রতিষ্ঠানের উচ্চ স্তরে কর্মরত নির্বাহীদের কার্যকে প্রশাসন এবং মধ্য ও নিম্ন পর্যায়ে কর্মরত ব্যবস্থাপকদের কার্যকে ব্যবস্থাপনা নামে আখ্যায়িত করা হয় ।

২. ব্যবস্থাপনা (Management) : উপকরণাদিকে সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্যার্জনের জন্য পরিকল্পনা, সংগঠন, কর্মীসংস্থান, নেতৃত্ব দান ও নিয়ন্ত্রণ কার্যকে ব্যবস্থাপনা বলে । মানবীয় ও বস্তুগত উপকরণ যতোই উন্নত হোক না কেন ব্যবস্থাপনা কার্যাদি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা না হলে তা কার্যক্ষেত্রে কোনোই ফল দিতে পারে না । এরূপ উপকরণাদি কোথাও একত্রে থাকলেই তা সংগঠন হয় না তাকে প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন বিভাগ ও উপবিভাগে সাজিয়ে তাদের প্রত্যেকের করণীয় নির্ধারণ করে দিতে হয় । আর এভাবেই ব্যবস্থাপনা সংগঠন পরিচালনায় কার্যকর শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখে ।

৩. প্রশাসন (Administration) : ব্যবস্থাপনার সর্বোচ্চ স্তরে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে প্রশাসক এবং তাদের কর্মপ্রয়াস বা প্রচেষ্টাকে প্রশাসন বলে। J. W. Sheultz (শিউলজ) তাই বলেছেন, ‘যারা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য নির্ধারণ করেন এবং যাদের অধীনে সংগঠন এবং ব্যবস্থাপনা উক্ত উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করে তাই প্রশাসন' । প্রশাসন হলো মানব দেহের মস্তিষ্কস্বরূপ । কারণ মস্তিষ্ক করণীয় নির্দেশ করে; যা শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা বাস্তবায়িত হয় । প্রশাসন প্রতিষ্ঠানে নীতি ও উদ্দেশ্য ঠিক করে এবং তা বাস্তবায়নের জন্য ব্যবস্থাপনা ও সংগঠনের সহায়তা গ্রহণ করে ।

সংগঠন, ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনের মধ্যে সম্পর্ক নিরূপণে অলিভার শেল্ডন বিশেষভাবে প্রয়াস চালিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “শিল্পের অংশ হিসেবে ব্যবস্থাপনা মূলধন ও শ্রম থেকে আলাদা এবং এটি তিনটি প্রধান অংশে বিভক্ত । অংশগুলো হলো-প্রশাসন, ব্যবস্থাপনা ও সংগঠন ।'

উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে প্রশাসনের কাজ মস্তিষ্কের ন্যায় যা নীতি-পদ্ধতি নির্দিষ্ট করে। সংগঠন কিভাবে চলবে ব্যবস্থাপনা তার পথ প্রদর্শন করে বা উপায়-উপকরণ কিভাবে কার্যকররূপে ব্যবহৃত হবে তার উপায় নির্দেশ করে । অন্যদিকে সংগঠন হলো উপকরণাদিকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করার উপায় । তাই বলা হয়ে থাকে সংগঠন বাহু, ব্যবস্থাপনা চক্ষু এবং প্রশাসন মস্তিষ্ক ।

Content added By

বাংলাদেশে ব্যবস্থাপনার সমস্যা

বাংলাদেশ একটা উন্নয়নশীল দেশ। শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে । এ দেশের ব্যবসায়ের প্রায় ৮৫% ক্ষুদ্র একমালিকানা ব্যবসায়। যেখানে ব্যবস্থাপনা ও মালিকানা থাকে এক ও অভিন্ন। তাই ব্যবস্থাপনার মান এবং তা উন্নয়নের বিষয়টি সেখানে কখনই তেমন গুরুত্ব পায় না । অবশিষ্ট যা বৃহদায়তন  ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেখানেও ব্যবস্থাপক নিয়োগে তাত্ত্বিক জ্ঞানের বিষয়টি উপেক্ষিত থাকে। তাই যে কোনো বিষয় থেকে ডিগ্রি নিয়েই কোনো ব্যক্তি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে স্বাভাবিকভাবেই কিছু সীমাবদ্ধতায় ভোগেন । আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহে ব্যবস্থাপনার মান দুঃখজনক । সরকারি কর্তা ব্যক্তিগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা দোষে দুষ্ট থাকেন । ক্ষমতা ভোগ ও তা প্রদর্শনেই তারা স্বাচ্ছন্দবোধ করেন । তাই ব্যবস্থাপনার মান উন্নত করে প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জন ও জনগণকে সেবা করার বিষয়টি কখনই গুরুত্ব পায় না। তদুপরি দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, দলীয় লেজুড়বৃত্তি, নির্লজ্জ দলীয়করণ, বিভিন্নমুখী চাপ ব্যবস্থাপনাকে সবসময়ই অসহায়ত্বের সম্মুখীন করে । এর বাইরে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা যা রয়েছে তাদের কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপকদের মান উন্নয়নে কিছু কর্মসূচি নিলেও দেশের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা নানান সমস্যার নিগড়ে বন্দী । নিম্নে কতিপয় সমস্যা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো :

১. প্রতিযোগী ব্যবসায় পরিবেশের অভাব (Lack of competitive business environment) : আমাদের দেশের ব্যবসায় জগতে এখনও কার্যত একচেটিয়া ব্যবসায় পরিবেশ বিরাজমান। অদক্ষ ব্যবস্থাপনাও এখানে স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবসায় চালায় । নতুন নতুন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও প্রতিযোগী পরিবেশ গড়ে না ওঠার কারণেই এখানে ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন চিন্তা প্রবল নয় ।

২. পেশা হিসেবে মর্যাদার অভাব (Non professionalisation of managers) : উন্নত বিশ্বে ব্যবস্থাপনা পেশা হিসেবে অনেকটা মর্যাদা পেলেও আমাদের দেশে এটি এখনও পেশা হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। ফলে এ. পেশায় এমন লোকেরা সহজেই প্রবেশ করে যাদের এ বিষয়ে কোনো প্রাথমিক জ্ঞানও নেই । তাদের পরিচালিত ব্যবস্থাপনা প্রায় ক্ষেত্রেই 'হাতুড়ে' বিষয়ে পরিণত হয় । যেটাও এ দেশে ব্যবস্থাপনার মানোন্নয়নে একটি বড় সমস্যা।

৩. সহযোগী প্রতিষ্ঠানের অভাব (Lack of associate institution) : আমাদের দেশে ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে সহযোগী প্রতিষ্ঠানের অভাব রয়েছে। ব্যবসায় প্রশাসন কেন্দ্র (IBA), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট (BIM), বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (BPTAC)-এর মতো দু'একটা প্রতিষ্ঠান থাকলেও তার কার্যক্রম তেমন বিস্তৃত নয় । বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞানদানের যে পাঠ্যক্রম চালু রয়েছে তাও যথেষ্ট বলা যায় না ।

৪. দক্ষ ব্যবস্থাপকের অভাব (Lack of efficient managers) : বাংলাদেশে দক্ষ ব্যবস্থাপকের তীব্র অভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয় । ভালো উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপক যারা রয়েছেন তাদের ভালো দিকগুলোও যথাযথভাবে তুলে ধরা হয় না । বরং বিরূপ প্রচারণা হয় বেশি। তাই দোষ-ত্রুটিমুক্ত একদল সৎ ও দক্ষ ব্যবস্থাপক যদি জনসমক্ষে প্রচারণা লাভের সুযোগ পেত তাহলে অনেকেই তা দেখে উদ্বুদ্ধ ও দক্ষতা অর্জনে তৎপর হতো ।

৫. আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব (Absence of modern approaches) : আমাদের দেশের মালিক, ব্যবস্থাপক, শ্রমিক-কর্মচারী সবাই কার্যত গতানুগতিক মানসিকতার অধিকারী। আধুনিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি সম্পর্কে তারা সচেতন নন । যে কারণে ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে উদ্যম, উৎসাহ, দলীয় প্রচেষ্টা, নতুন চিন্তা-গবেষণা বাস্তব অর্থেই অনুপস্থিত । ফলে স্থবিরতা ও অদক্ষতা ব্যবস্থাপনার সর্বস্তরে বিরাজমান ।

৬. প্রশিক্ষণের অভাব (Lack of training) : আমাদের ব্যবস্থাপনার মানোন্নয়নের জন্য কোনো কার্যকর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি । ক্ষেত্রবিশেষে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলেও তা কার্যত তেমন ফলপ্রদ নয় । তাই ব্যবস্থাপনা বিষয়ে উন্নতির কথা কেউ ভাবলেও প্রশিক্ষণের অভাবে তাদের পক্ষে এর সুষ্ঠু প্রয়োগ সম্ভব হয় না ।

৭. শ্রমিক-ব্যবস্থাপনা সম্পর্কের অভাব (Lack of labour-management relations) : আমাদের দেশে শ্রম-ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক কাম্য মানের নয় । অদক্ষ ও অশিক্ষিত শ্রমিক-কর্মীরা নিজের কল্যাণ সম্বন্ধে অসচেতন। ট্রেড ইউনিয়নের নামে এ দেশে যা চলছে তা ভালো কিছু নয় । বেসরকারি অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের সাথে যে আচরণ করা হয় তাও অত্যন্ত দুঃখজনক । এরূপ অবস্থায় দক্ষ ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠতে পারে না ।

৮. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা (Political instability) : রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আমাদের দেশে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির প্রয়োগে আরেকটি বড় বাধা। আর এরূপ অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির মূল কেন্দ্র হলো শিক্ষাঙ্গন ও শিল্প এলাকা । এ ধরনের অবস্থায় মূলত ব্যবস্থাপকদের করার তেমন কিছু থাকে না । ফলে ব্যবস্থাপনা উৎসাহ হারায় এবং স্থবির ও অদক্ষ হয়ে পড়ে ।

উপসংহারে বলা যায়, ব্যবস্থাপনার সুষ্ঠু প্রয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি না হলে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয় । তাই ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যা দূরীকরণে এ দেশের সংশ্লিষ্ট সবাইকে যথাযোগ্য ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে ।

 

Content added By
Promotion